জিপি: স্পেকট্রাম নিয়ে গ্রামীণফোনের এক ‘কৌশলে’ আশংকায় রবি বাংলালিংক ও টেলিটক।
গ্রাহক সংখ্যায় দেশের সবচেয়ে বড় অপারেটর গ্রামীণফোন বিটিআরসির কাছে ৮৫০ ব্যান্ডে স্পেকট্রাম চেয়েছে। আর এতেই তৈরি হয়েছে জটিলতা।
রবি বাংলালিংক ও টেলিটকের আশংকা, বিটিআরসি গ্রামীণফোনকে ৮৫০ ব্যান্ডে ১০ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম বরাদ্দ দিতে পারে। যেখানে ব্যান্ড-৫ হতে আপলিংক- ৮২৫ হতে ৮৩৫ মেগাহার্জ এবং ডাউনলিংক- ৮৭০ হতে ৮৮০ মেগাহার্জ হবে। ৮৫০ ব্যান্ডের এই ডাউনলিংকই ইজিএসএম (এক্সটেন্ডেড জিএসএম) ব্যান্ডের ওভারল্যাপ, ব্যতিচার বা বাধার কারণ হবে।
ইজিএসএমে প্রাইমারি জিএসএম (জিএসএম-পি) ব্যান্ড ৯০০ এর নীচের দিকে ১০ মেগাহার্জ রয়েছে। এই বর্ধিত রেঞ্জ হলো ৮৮০ হতে ৮৯০ মেগাহার্জ এবং ৯২৫ হতে ৯৩৫ মেগাহার্জ। আর এই ৯০০ ব্যান্ডেই রবির রয়েছে ৯ মেগাহার্জ, গ্রামীণফোনের ৭ দশমিক ৪ মেগাহার্জ, বাংলালিংকের ৫ এবং টেলিটকের ৫ দশমিক ২ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম।
গ্রামীণফোনের সিনিয়র ডিরেক্টর কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স হোসেন সাদাত টেকশহর ডটকমকে বলেন, ‘স্পেকট্রাম বরাদ্দের ক্ষেত্রে গ্রামীণফোন সবসময় স্বচ্ছতা এবং সমান সুযোগে বিশ্বাসী। অপারেটরগুলোর মধ্যে লো-ব্যান্ড স্পেকট্রাম বিতরণের প্রয়োজনীয়তায় বিটিআরসির সাথে আমাদের আলোচনা চলছে।’
‘প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটি (ডুয়েল-ব্যান্ড রিলিজ) বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হবে, এ বিষয়ে বিটিআরসি সকল মোবাইল অপেরাটরদেরকে নিয়ে একটি পিওসি বা প্রুফ অফ কনসেপ্ট প্রক্রিয়া বিবেচনা করেছে। এই পিওসি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে আমরা আশাকরি সকল বিভ্রান্তি দূর হবে। পিওসি সম্পর্কিত বিটিআরসির বিবেচনাকে আমরা স্বাগত জানাই এবং আমাদের সবার এ ব্যাপারে সহযোগিতা করা প্রয়োজন।’ বলেন হোসেন সাদাত।
রবি বাংলালিংক টেলিটকের আপত্তির কারণ :
বিটিআরসি যদি গ্রামীণফোনকে ৮৫০ ব্যান্ড হতে স্পেকট্রাম দেয় তাহলে প্রথমেই তা গ্রাহক অসন্তুষ্টির কারণ হবে। এই ব্যান্ডের ব্যতিচার বা বাধায় গ্রাহক উচ্চ কলড্রপ, ডেটার গতি কমবে, ভয়ে কলের মান নেমে যাবে।
তিন অপারেটরকেই ফিল্টার বসাতে অনেক খরচ করতে হবে। হাজার হাজার সাইটে এই ফিল্টার বসাতে হবে।
এন্টেনা আলাদা করতে হবে বা দূরত্বে নিতে হবে। এটি প্রায়ই ক্ষেত্রে মুশকিল হতে পারে কারণ অপারেটরগুলোর অসংখ্য এন্টেটা একই ভবন বা পাশাপাশি ভবনে রয়েছে। শহরে বা বেশি ঘনবসতির এলাকায় এটি চ্যালেঞ্জিং হবে।
বাইরে স্থাপিত ফিল্টার মেইন্টেন্যান্সে নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে। ফলে গ্রাহক বেশ ভোগান্তির মধ্যে পড়বে।
ফিল্টার স্থাপনের কারণে বর্তমান কাভারেজ এলাকা কমে যেতে পারে।
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম টেকশহর ডটকমকে বলেন, আমাদের অনুরোধেই বিটিআরসি পিওসি বা প্রুফ অফ কনসেপ্ট প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা এই সিদ্ধান্ত স্বাগত জানাই। এতে প্রমাণিত হবে কী ঘটবে।
‘তবে আমাদের নিশ্চিত হবে হবে এই বরাদ্দর কারণে আমারা কোনোভাবেই ভোগান্তি বা ক্ষতিগ্রস্ত হবো না’ উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলালিংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিটিআরসির কাছে তারা তাদের আশংকার কথা জানিয়েছেন।
টেলিটকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বিটিআরসির সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন।
কী করছে বিটিআরসি ?
বিটিআরসি বাস্তবতা যাচাই করেই এই স্পেকট্রাম বরাদ্দ দিতে চায়। নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি বলছে, তারা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না যেখানে টেলিযোগাযোগ খাতে কোনো অসামঞ্জস্য পরিস্থিতি তৈরি হয় কিংবা এক অপারেটর আরেক অপারেটরের ভোগান্তির কারণ হয়। সবার আগে সেখানে গ্রাহক স্বার্থই দেখা হবে।
বিটিআরসির কমিশনার প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ টেকশহর ডটকমকে বলেন, ৮৫০ ব্যান্ডে গ্রামীণফোনের স্পেকট্রাম চাওয়ার আবেদন বিটিআরসি যাচাই-বাছাই করছে। এটি বরাদ্দ দিলে কী প্রতিক্রিয়া হবে বা কোনো সমস্যা হবে কিনা তা দেখেই তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এদিকে বিটিআরসি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়েই আলোচনা অব্যহত রেখেছে। পিওসি বা প্রুফ অব কনসেপ্ট কোথায় কীভাবে, কী ধরণের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে হবে তা নিয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশদ আলোচনা করবে অপারেটরগুলোকে সঙ্গে নিয়ে। পিওসি হলো, যেখানে পুরো প্রক্রিয়াটি মাঠে পরীক্ষা করে দেখা হবে, কী প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব হয়।
ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) কী রেফারেন্স :
আইটিইউ প্রতিবেদন, গাইডেন্স অব রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক ফর ন্যাশনাল স্পেকট্রাম ম্যানেজমেন্ট অনুযায়ী যে নীতি সেখানে, নতুন করে বরাদ্দ দেয়া স্পেকট্রাম আগের স্পেকট্রামে কোনো ব্যতিচার বা বাধার কারণ হবে না।
আর জাতীয় স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনার নীতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ক্ষতিকারণ বাধা বা ব্যতিচার হতে আগের সেবাকে নিরাপদ রাখা মূলনীতি।
গ্রামীণফোন ছাড়া অন্য তিন অপারেটরের সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রামীণফোন বাকিদের ভোগান্তির উদ্দেশ্য নিয়েই এই স্পেকট্রাম চেয়েছে। গ্রামীণফোন স্পেকট্রাম কিনবে এতে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা না কিন্তু তা যদি অন্যদের ভোগান্তির কারণ হয়, সমস্যা তৈরি করে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।
তাদের কেউ কেউ বলছেন, গ্রামীণফোন জানে এই ব্যান্ডে স্পেকট্রাম চাইলে আপত্তি আসতে পারে। এতে যদি বিটিআরসি স্পেকট্রাম না দেয় তখন তারা সেবার মান ইস্যুতে বলতে পারবে যে, স্পেকট্রাম না পাওয়ার কারণে কাঙ্খিত মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
এ স্পেকট্রাম সংশ্লিষ্ট পুরো ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে কাজ করছে বিটিআরসি।
দেশে কোথায় কতো স্পেকট্রাম ?
রেডিও রেগুলেশন অনুযায়ী বাংলাদেশে ব্যবহারযোগ্য স্পেকট্রাম ৮১৫ মেগাহার্জ। যেখানে ইতোমধ্যে ৩৮১ দশমিক ৬ মেগাহার্জ মোবাইল ফোন অপারেটরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান,বাহিনী ও সংস্থা বরাদ্দ নিয়েছে। বাকি আছে ৪৩৩ দশমিক ৮ মেগাহার্জ।
এরমধ্যে এখন পর্যন্ত মোবাইল ফোন অপারেটররা বরাদ্দ নিয়েছে ৩৭৬ দশমিক ৬ মেগাহার্জ। এই স্পেকট্রাম নবায়ন করার সঙ্গে ভবিষ্যতে বাকি ৪৩৩ দশমিক ৮ মেগাহার্জ তরঙ্গও পাবে অপারেটররা।
ইতোমধ্যে ২০২২ সালে গ্রামীণফোন ও রবি ২৬০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে যথাক্রমে ২০ মেগাহার্জ করে ৪০ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম চেয়ে আবেদন করেছে। বাংলালিংকও সামনে ২৩০০ ব্যান্ডে ২০ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম চেয়ে আবেদন করে রেখেছে।
সংকট কোথায় ?
জিএসএমের পর্যবেক্ষণ বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে সব মোবাইল ফোন অপারেটর মিলে ২ হাজার মেগাহার্জ স্পেকট্রাম দরকার হবে। জিএসএমের পর্যবেক্ষণকে ধরলে বাংলাদেশে আগামী ৭ বছরের মধ্যে আরও ১১৮৫ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম দরকার হবে।
বিটিআরসি বলছে, দেশের গ্রামাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৭০০ এবং ৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ড স্পেকট্রাম উপযোগী বেশি। এই দুই ব্যান্ডে বরাদ্দযোগ্য স্পেকট্রাম আছে ৬৩ দশমিক ৪ মেগাহার্জ। যেখানে ৭০০ ব্যান্ডে থাকা ৪৫ মেগাহার্জের পুরোটাই এখনও বরাদ্দযোগ্য রয়েছে আর ৮০০ ব্যান্ডে ২০ মেগাহার্জের মধ্যে ১ দশমিক ৬ মেগাহার্জ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ২০২৪ সালের শুরুতে এই স্পেকট্রাম বরাদ্দ দিয়ে দিতে চায়। অন্যদিকে ২০২৬-২০২৭ সাল নাগাদ দেশে বাণিজ্যিকভাবে ৫জি চালু হয়ে গেলে ৩৫০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে ৩০০ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম বরাদ্দ দিতে হবে। ৩৫০০ ব্যান্ডে বাংলাদেশের কাছে ব্যবহারযোগ্য স্পেকট্রামই রয়েছে ৩০০ মেগাহার্জ।
তাহলে ২০২৭ সালের পর বিটিআরসির কাছে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বরাদ্দ দেয়ার জন্য নতুন কোনো ব্যান্ডে-স্পেকট্রাম থাকছে না।